Magic Lanthon

               

হালিমা খুশি

প্রকাশিত ১৩ জুন ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

উত্তরের সুর ‘পশ্চিমে’ ধায়

হালিমা খুশি

হুদ্‌ম্যারা সাত ভাই কারো চকোত পানি নাই

হুদ্‌ম্যা নিলো নাঙ্গল জোঙ্গাল

হুদ্‌মী নিলো মই

আদ ঘাটাত যায়য়া হুদ্‌ম্যা

চেতর হয়া পইল

 

ছোটোবেলায় কাদা মাটির হুদ্‌ম্যা পুতুল বানিয়ে, সেই পুতুল নিয়ে সবার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ‘হুদ্‌ম্যা দেও’-এর গান হতো; তারপর সবাই মিলে সেটা ভাসাতো পুকুরে। কীভাবে যেনো কখনো কখনো বৃষ্টিও নামতো! চৈত্র-বৈশাখ মাসের খাঁ-খাঁ রোদে, এক ফোঁটা পানির জন্য বৃষ্টির দেবতা হুদ্‌ম্যার সন্তুষ্টির জন্য হতো এ আয়োজন। বৃষ্টি প্রার্থনার এ আয়োজন ৯০ দশকের মাঝামাঝিতেও দেখা যেতো উত্তরের বিভিন্ন গ্রামে। কিন্তু এখনকার শিশুরা হয়তো হুদ্‌ম্যার নামই শুনেনি! অথচ এককালে গ্রামীণ জীবনে হুদ্‌ম্যা দেও-এর গীতের মতো গর্ভধারণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রায় সব পর্যায়ের অসংখ্য লোকসঙ্গীতের ব্যবহার ছিলো। কিন্তু সেই ভাণ্ডার আজ অনেকটাই মলিন—নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে কেবলই বইয়ের পাতায়। গ্রিক দর্শন বলে, ‘কোনো জাতি উৎকর্ষের কোন্‌ স্তরে আছে, তা সে জাতির সঙ্গীতের দ্বারাই পরিমাপ করা যায়।’ এখন নতুন মোড়কে কোনো কোনো লোকসঙ্গীতের পরিবেশন দেখে, বুঝতে আর কষ্ট হয় না উৎকর্ষের কোন্‌ স্তরে আছি আমরা। অথচ স্বকীয়তাকে অবদমিত করে জাতে ওঠার এক লোলুপ বাসনায় পরদেশি সংস্কৃতিকে আপন করানোর চেষ্টায় এখন ব্যস্ত সবাই। কিন্তু পরভূমের সংস্কার চর্চায় কি আত্মোৎকর্ষ, আত্মমুক্তি ঘটে; জাতে ওঠা যায়?

অবশ্য সেই স্বার্থ চরিতার্থ করতে শিল্পীকে এখন আপন মনে নয়, গান বাঁধতে হয় নির্ধারিত গণ্ডিতে, যেখানে তার বিশ্বাস, আবেগ, অনুভূতির ছাপ নেই, আছে কেবল বাজারি মেজাজ। কিন্তু লোকসঙ্গীত মানে তো সেখানে থাকবে মানুষের কথা। এখনো সেই মানুষ আছে, তবে সে কোন্‌ মানুষ? সেখানে শিল্পীর প্রয়োজন থাকলেও তার সত্তা অপ্রয়োজনীয়! কিন্তু যিনি এই স্রোতে নিজের অস্তিত্বকে ভাসাতে চান না, রাষ্ট্রের দৌরাত্ম্যে তিনি কি টিকে থাকতে পারেন? রাষ্ট্রের প্রতি তার ক্ষোভ থাকলেও সেটা তাকে ঘিরে যেভাবে পাক খায়, তার বিরুদ্ধে কি যেতে পারে কেউ? হয়তো কেউ পারে, তবে বেশিরভাগই পারে না। তাহলে শত বছরের লালিত এই চিন্তন কি এক নিমিষেই ভেস্তে যাবে তথাকথিত আধুনিকতা-গণতন্ত্র-পুঁজির জোয়ারে!

সময়-প্রয়োজন-সমাজ-বাস্তবতার সঙ্গে লড়তে থাকা এই রকম একটি লোকসঙ্গীতের প্লটকে, শাহ্‌নেওয়াজ কাকলী ‘চাঁন মিয়া’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে হাজির করার চেষ্টা করেছেন তার উত্তরের সুর চলচ্চিত্রে। কাহিনি এগিয়েছে শিল্পী-চাঁন ও ব্যক্তি-চাঁনের দ্বন্দ্ব, তার দুঃখ, হতাশা, প্রতিবাদ, পরাজয়কে ঘিরে।

 

কথায় কথায় অনেক কথাই হয়

কেবল হয় না বলা তার কথা

সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। প্রয়োজন, ভেঙে পড়া দেশটাকে নতুন করে দাঁড় করানোর। কিন্তু রাষ্ট্র তখন অনুদানের অর্থ লুটপাট, বিরোধী নিধনে ব্যস্ত; দেশে যেনো আবার প্রতিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ও পরবর্তী সময়ে বন্যা, গোটা ৭০ দশক জুড়ে সমাজ-সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ বাঁচার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাতে থাকে নগরে, বিশেষ করে ঢাকায়। সদ্য বাস্তুহারা এই ‘নগর-গরিব’দের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য অনেক অনুষঙ্গের মতো সঙ্গীত ব্যবসায়ও এক নতুন পরিকল্পনার শুরু হয়। ততোদিনে, মানে ৮০ দশকের গোড়ার এই সময়ে অডিও প্রযুক্তিকে অনেকখানি সহজলভ্য করে তোলা হয়েছে, একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্য ফেরত অভিবাসীদের সঙ্গেও আসছে ক্যাসেট-প্লেয়ার, তা যাচ্ছে গ্রামে। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ‘উন্নয়ন’ প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক এই রকম একটি সময়ে ভোক্তা বানানোর প্রক্রিয়ায় নতুন ধারার এক গানের জন্ম দেওয়া হয়—নাম তার ‘আরবান ফোক’। যে গানের সুর আসতে থাকে সেই গ্রামীণ, খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে, আর তার ওপর কথা বসতে থাকে শহরের।  

সেই গানে ওই মানুষগুলোর প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা, পাওয়া না-পাওয়ার বেদনা, প্রত্যাশা, প্রতিবাদ, মাটির টান, জীবনবোধের চিহ্ন মাত্র ছিলো না। অথচ মানুষ কিনা এটাকেই গ্রহণ করেছে! কেননা ঐতিহাসিক পরিক্রমায় ‘ ... অর্থনৈতিক প্রয়োজনসিদ্ধির মাধ্যম হিসেবে এক একটি উৎপাদন পদ্ধতি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর সংস্কৃতি পরিকাঠামো তৈরি করে দেয়।’ তাই সংস্কৃতি যখন অর্থ উৎপাদনের ছকে বন্দি, উদ্দেশ্য যখন আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে তোলা, তখন তার দার্শনিক অবস্থান, মার্মিকতা কি নির্মিত না হয়ে পারে?     

অথচ গীত, বাদ্য ও নৃত্য—এই তিন মিলে প্রায় দেড় শত লোকগানের বৈচিত্র্যময় ধারায় আমাদের যে চিত্রণ আছে, সেখানে মিশে আছে সবাইকে নির্জলা আনন্দস্পর্শ দেওয়ার অকৃত্রিম প্রচেষ্টা। কিন্তু এ সবকিছুকে ছাপিয়ে, বৈচিত্র্যকে দাবিয়ে চেষ্টা চলছে গানের একটা মাত্র নির্দিষ্ট মানকে আদর্শ ধরে একই ছাঁচে নির্মাণের। এ কি কেবল আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তোলার জন্য, নাকি শিকড়-বাকড়হীন সংস্কৃতিতে অভিযোজিত করে তোলা, যাতে প্রয়োজন মতো বাজার বাড়াতে সমস্যায় না পড়তে হয়; অন্যদিকে তার ওপর নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠা করা যায়? কিন্তু সন্তানের মতো করে গানটাকে ধারণ করে তাকে লালন করেন যে শিল্পী, সে কি তার ওপর ভাগ বসানো মেনে নিতে পারেন? তাহলে মানতে না পারলে সেই শিল্পীকে কী করে মেনে নিবে রাষ্ট্র; তার পছন্দ যে কেবল অধীনতা!

যাত্রার কথাই ধরুন। অস্তিত্ব ধরে রাখতে বার বার আপস করতে হয়েছে শিল্পীদের—নিজের সঙ্গে, ব্যবসার সঙ্গে। যে যাত্রায় একসময় শিল্পী-শ্রোতার হাসি-কান্না এক হয়ে যেতো, এখন তার খেলা কেবল ‘আদিম’ আনন্দ নিয়ে। কিন্তু সেখানে শিল্পী না পারেন নিজেকে অনুভব করতে, না পারেন বেরিয়ে আসতে। একদিকে পুরো সত্তা জুড়ে খেলা করে শিল্পী সত্তা, অন্যদিকে আপস আর মাঝখানে কেবলই অন্তঃক্ষরণ; অথচ দেখার অবকাশ কারো নেই।

লোকসংস্কৃতির এই দশাতে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বাউলগানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়; ভালো কথা। কিন্তু তত্ত্বাবধানের নামে যে বাউলগানকে উপস্থাপন করা হয়, আসলেই কি তা এ ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে? যদি না করে, তবে আগ বাড়িয়ে সংস্থাটির দায়িত্ব নেওয়ার কারণটাই বা কী? ‘সেইফগার্ডিং প্রজেক্ট’ কারণটাকে স্পষ্ট করে তোলে; যেখানে তারা প্রস্তাব করেন বাউল-গুরু ও শিক্ষানবিশদের একত্রীকরণের কর্মশালা, বাউলশুমারি, বাউলগানের ডকুমেন্টেশন ও প্রকাশনা এবং সর্বশেষ বাউল সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে বাউলমেলা আায়োজনের। কিন্তু এই করে কি আসলে বাউলগানকে রক্ষা করা যায়?

পুঁজিপতিরা যেখানে সবকিছুকে পণ্য করছে, সেখানে ইউনেস্কো অন্তত রক্ষার চেষ্টাটুকু তো করছে! ধন্ধটা কেটে যেতে সময় লাগে না, যখন দেখি বাউলকে ধরে তওবা পড়ানো, চুল-দাড়ি কেটে দেওয়ায় ইউনেস্কোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। অথচ বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণের মহান দায়িত্ব নাকি তাদের-ই হাতে! তাহলে এই প্রজেক্ট কাকে ‘সেইফ’ করবে—বাউলগানকে, নাকি কর্তৃত্বের পথকে?

লোকসঙ্গীতকে কি তাহলে এভাবে আপস করে, স্বপ্নহীন হয়ে বাকিটা পথ হাঁটতে হবে? এই দ্বিধা নিয়ে চলতে থাকে উত্তরের সুর। যেখানে শিল্পী-চাঁন নেশায়-পেশায় গেয়ে চলেন ভাওয়াইয়া। কিন্তু দিন বদলের মতো বদলাতে থাকে তার গানের শ্রোতার রুচি। বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে চান না চাঁন মিয়া। একসময় অসুস্থ মেয়ের আবদার পূরণে নিরুপায় হয়ে পড়েন; বাধ্য হন গান ছাড়তে। অথচ তার অস্তিত্ব যে দোতারার সঙ্গে বাঁধা।

মুই তাও গাইম ...

শিকার যখন মানুষের জীবিকাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে তখন তাদের ‘... নাচ, গান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, পুরাণবৃত্ত, দেবতাকল্পনা, আচার, সংস্কার, বিশ্বাস, রাজনীতি ইত্যাদি সবকিছুর সঙ্গেই পশু ও পশুশিকারের ব্যাপারটি জড়িয়ে ...’ ছিলো। তেমনই জীবিকার কেন্দ্র যখন ছিলো কৃষি, সেই সময়ের সাংস্কৃতিক পরিকাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলো তা। তাই পুঁজি-যন্ত্র-কারখানার এই সময়ে, গান করবে বলে চাঁন যতোই দাদার পিছন ছুটে যাক না কেনো, যতোই দাদা বলুক না কেনো-নাতি তার ‘শ্যারের চ্যায়য়া সোয়া শ্যার হইবে’, তার মতো এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াবে; কিন্তু চাঁন পেরে উঠবে তো? তার পরও চাঁন একই আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা নিয়ে গান বাঁধেন; তাতে মিশে থাকে তার আক্ষেপ, আকাঙ্ক্ষা; কিন্তু থাকে না কেবল শোনার মানুষ।

তাহলে সেই শোনার মানুষগুলো এখন কী শোনে, কেনোই বা শোনে? চাঁনের গানে কি এখন আর আগের মতো মিশে যাওয়ার জাদু নেই? তবে কি তার প্রতিযোগী জাদু তৈরি করে ফেলেছে কেউ? তারই বা দরকার পড়লো কেনো? এতো প্যাঁচ বোঝেন না চাঁন। তবে এটা বুঝতে পারেন, তার গান এখন আর কাউকে আনন্দ দেয় না; তাহলে কার গান দেয়, কেনোই বা দেয়? কিন্তু ওদিকে যে তার সংসারের যায় যায় অবস্থা; খাবার নেই, কাপড় নেই। চাঁনের বউ আম্বিয়া রাগ করে বলেন, ‘তোমার ওই দোতারা ডাঙ্গার গান কায়য়ো (কেউ) শোনে না, খালি নাকি দাড়ে শুনি চলি যায়, তাইলে ওই যন্ত্র নিয়্যা যাওয়ার দরকারটা কী?’ তবুও চাঁন প্রতিজ্ঞ, দোতারা হাতে গান করার। গানটা যে কেবল তার পেশা নয়, অভিব্যক্তিও বটে! কিন্তু চাঁন আদতে পারবে কি পারবে না, তার নির্ধারক চাঁন নন; তাহলে সেটা কে বা কারা?

শিল্পের পাকে, বিপাকে শিল্পী-চাঁন

চাঁন মিয়াকে আম্বিয়া বলেন, ‘সারা দুনিয়ার মানুষ ঘাটা (রাস্তা) বানাবার কাম করে, তোমরা পারেন না, দুই বেলা ভাত তো জোটে।’ চাঁন বলেন, ‘আরে মূর্খ বেটিছাওয়া, গান বাজনার তুই কী বুজবু।’ চাঁন মিয়া গান বোঝেন ঠিকই, কিন্তু বাজার বোঝেন না। এসব বিকানো জটিলতা তার মাথায় খেলে না, তার খেলা যে কেবল সুর নিয়ে। কিন্তু শিল্পী-চাঁনের যে একটা ব্যক্তিসত্তা আছে, যে খেতে চায়, খাওয়াতে-পরাতে চায়; কিন্তু পেরে ওঠে না। আবার মৃতপ্রায় মেয়ের পোলাও খাওয়ার আকুতি তাকে নিরুপায় করে ফেলে। তার পরও গান ছাড়তে চান না চাঁন। শিল্পী-চাঁন মিয়ার সঙ্গে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব চলে ব্যক্তি-চাঁন মিয়ার। এ দ্বন্দ্বে শিল্পী-চাঁন মিয়া হার-জিতের দোলাচলে দোতারা হাতে সুর তুলে চলেন হাটে-ঘাটে-স্টেশনে। কিন্তু অনেকের কাছেই আজ এই দ্বন্দ্ব যে মূল্যহীন! তাই তো চাঁন মিয়ার দোতারা আর তাদের টানে না, মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা গান তাদের আর ভালো লাগে না। কিন্তু ব্যক্তি-চাঁন মিয়ার বেঁচে থাকার জন্য তো চাল-ডাল-তেল লাগে।

তাই কখনো কখনো নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জয়ী চাঁন মিয়াকে অন্যদের কাছে ‘হেরে’ চাল-ডাল বাদ দিয়ে ফিরতে হয় শুধু আলু নিয়ে। এভাবে শেষ পর্যন্ত শিল্পী-চাঁন মিয়ারা পারেন না, পারা যায় না। তাহলে শিল্পী-চাঁন কি এভাবেই হেরে যাবেন?

দেহের ভিতর সবার পেট আছে, মন আছে কয়জনের

‘মানুষ মানুষের কাছ থেকেই শেখে, প্রদীপের দ্বারাই প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত হয়, জলের দ্বারাই জলাশয় পূর্ণ হয়’; মধ্যযুগের শেষ পর্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথের এই কথার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে আমাদের সংস্কৃতিতে। একসময় যে বিনোদন ছিলো শ্রমের ক্লান্তি উপশমক, ধীরে ধীরে পুঁজির কবলে পড়ে সে বেড়ে উঠতে থাকে ভোগ্যবস্তু পাওয়ার উদগ্র বাসনা সৃষ্টিকারী হিসেবে। কিন্তু যে মানুষগুলো মাটির সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পথ চলতে চায়, যাদেরকে উটকো বস্তুকাঙ্ক্ষা স্পর্শ করতে পারে না, তারা কি এর বাইরে গিয়ে টিকে থাকতে পারে, অন্য অর্থে টিকতে দেওয়া হয়? উত্তরের সুর-এ চাঁন মিয়া গানে গানে সবাইকে জানিয়ে দেন, ওরে মুই বাজাং মোর সাধেরও দোতারা, তাতে মানুষের কী?’ কিন্তু সবাইকে উপেক্ষা করে দোতারাকে সঙ্গী করার ক্ষমতা চাঁনের আছে কি? তার মনের খোরাক না হয় মেটে, কিন্তু পেটের? যদিও চাঁন বলেন, ‘মন ভরি গেইলে পেট ভরি যায়’; কিন্তু পরিবার তো তা বোঝে না। নিত্য এই দ্বন্দ্ব হয়তো তাকে নতুন কোনো সৃষ্টির প্রেরণা জোগায় কিন্তু সেটাই বা কতোদিন?

দ্বন্দ্বটাকে জিইয়ে রাখে পরিবার, তা কারণ হয়ে দাঁড়ায় চাঁনের আপসের, পরাজয়ের। পরিবারের মধ্য দিয়ে যে অনুশাসনের চর্চা শুরু হয়, তারই পাকাপোক্ত রূপ দেখা যায় রাষ্ট্রের সব নিপীড়ন মেনে নেওয়ার মাধ্যমে। কারণ পরিবার রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ, সেখানেও সর্বময় ক্ষমতায় একজন নিয়ন্ত্রণকারীই থাকেন। চাঁন রাষ্ট্রের চাওয়াকে মেনে নিয়ে তাই বলেন,  ‘ছাওয়ার চাইতে কি দোতারা বড়ো?’ আপাত মনে হয়, পরিবারকে বাঁচাতে চাঁন ঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। কিন্তু ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের ধুয়া তুলে যে পরিবার টিকে থাকে, সেখানে ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের চাপে ব্যক্তির অস্তিত্ব চিড়েচ্যাপ্টা না হয়ে পারে?  

কেননা কাঠামো ঠিক রাখতে ব্যক্তির ওপরেও চাপ দেয় রাষ্ট্র, অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোথায়? রাষ্ট্র চাঁনের আপাত কর্মসংস্থানের জন্য মাটি কাটার ব্যবস্থা করে, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থায় টাকা, চাল, গম বিতরণ করে। কিন্তু ওই পড়ালেখা ভালো লাগে না আয়শার, তার ভালো লাগা গানে; তাই সে বাবাকে বলে, ‘মোর তোমার সাথে গান গেয়্যয়া ব্যাড়াইতে ভাল্লাগে।’ অন্যদিকে চাঁনও পারেন না মাটি কাটতে। কিন্তু তারা যা পারে, যা করতে ভালোবাসে—তা করতে দেওয়া কি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে বাঁচার অধিকার তো আছে। অথচ চাঁনের শিল্পী সত্তার ভার নেয় না রাষ্ট্র। উপরন্তু গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি দেওয়ার মতো বিশ্বময় করে তুলতে চায় দেশীয় সঙ্গীতকে। শঙ্কিত-ভারাক্রান্ত-আকুল চাঁন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আইজ যদি হামার একটা ভাওয়াইয়া স্কুল থাকলো হয়, হামার ছওয়াক খাওয়া দিয়া ডাকলো হয়, ওটে হামার ছওয়া গান শিখি কতো বড়ো শিল্পী হইল হয়।’

স্বপ্ন কি সত্যিই ফুরোয়!

কাঁধে দোতারা, হাত ধরে আছে মেয়ে আয়শার, পা দুটো চর ধরে হেঁটে চলেছে কর্মস্থলে। উত্তরের সুর-এ এই হলো নিত্য দিনের পুরোদস্তুর চাঁন। এর থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশাও নেই, তবে স্বপ্ন-রীতি ভাঙার আক্ষেপ আছে চাঁনের। তবুও তার সৃষ্টি থেমে নেই। আপন মনে একের পর এক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির অকৃত্রিম ফর্দ তুলে চলেছেন কথায়, সুরে। এ সত্তা নিয়ে তিনি গর্ব করে বলেন, ‘আল্লাতালা শিল্পীক নিজের হাতোত তৈরি করিয়্যা দুনিয়াত পাঠায়। ... সবার মাঝোত সুর সৃষ্টি কইরব্যার ক্ষমতা আল্লা দেয় না। ... দুই চাইর গ্রামের মানুষ, মোক এক নামোত চিনি ফালায়।’ সে তো ঠিকই আছে, কিন্তু সুরুজ যখন বলেন, ‘নাম দিয়্যা তোর কী হইবে, কাম করলে না দাম’—সেটাকেও ফেলে দেওয়া যায় কি? তার মানে এই শিল্প সৃষ্টি কোনো কাজের আওতায় পড়ে না, তার উপযোগিতা অন্য অর্থে চাহিদা কিংবা বাজারমূল্য নেই বলে?

অন্যদিকে প্রাচীন শিল্পমাধ্যম হয়েও চিত্রশিল্প কিন্তু দিব্যি টিকে আছে। অথচ শিল্প হিসেবে লোকসঙ্গীত যতোটা সাধারণের কাছের, চিত্রটা কিন্তু ঠিক ততোটাই দূরের। কেননা তার জন্য জানতে হয়; পড়তে হয়। তথাপি বাজারে এখনো চিত্রশিল্পের কাটতি আছে বেশ, যেটা হারাতে হয়েছে লোকসঙ্গীতকে। কিন্তু লোকসঙ্গীতের বেলায় এমনটা ঘটানোর প্রয়োজন পড়লো কেনো? লোকসঙ্গীত বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে ধারণ করে বলে? তাদেরকে ব্যবসার টার্গেটে পরিণত করলে ঝুলিতে মুনাফার অঙ্কটা বেশ ভারি হয় বলে?

তবে দিব্যি ভালোভাবে চলতে থাকা এই চিত্রশিল্প জগতের একজন মুর্তজা বশীর, কোনো বাণিজ্যিক কিংবা ফরমায়েশি কাজ করেন না। কিন্তু তাকে প্রদর্শনী করতে হয় ছবি বিক্রির জন্য। কারণ তাকে খেতে হয়, খাওয়াতে হয়, চিকিৎসা করাতে হয়। অথচ উত্তরের সুর-এ সেই সক্ষমতা নেই চাঁনের। তাকে বলতে হয়, ‘অ্যালা আর কাহো গান শোনে না, পাইস্যা দেয় না; ভিক্ষ্যা করা ছাড়া হামার আর কোনো পথ নাই রে।’ কিন্তু শিল্পী হিসেবে চাঁনের শিল্প সৃষ্টির তাড়না মুর্তজা বশীরের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। তবে দুই শিল্পমাধ্যমের মূল্যায়ন ভিন্ন হওয়ার কারণটা কী? শিল্প তো শিল্পই, তার আবার ভিন্নতাই বা কীসে? তবে সেই মূল্যায়নের মানদণ্ড কী?

শিল্পের জন্য শিল্প, নাকি মানুষের বা অর্থের!

শিল্প কথা বলে, হাঁটাচলা করে, অনেক সময় বাতলে দেয় সমাধানের পথও। কিন্তু যখন তা নড়বে না, নাড়াবে না; হাসবে না, হাসাবে না; কাঁদবে না, কাঁদাবে না—তখন কি তার শিল্পগুণ অক্ষুণ্ন থাকবে? এই গুণের উপস্থিতি কি খুব জরুরি? মুর্তজা বশীর সুন্দর করে বলেন, ‘... কর্মফলে তুমি পরজীবনে সিদ্ধার্থ হতে পার, মুচিও হতে পার। তবে এ জীবনে যদি তুমি কৃতিত্ব রেখে যেতে পার, তাহলে তুমি চিরস্থায়ী হবে।’ হয়তো এ কারণেই তার সৃষ্টি জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি যখন ছবি আঁকেন, কবিতা কিংবা গল্প লেখেন তখন হয়তো ভাবেন না বাজারে তা কতোখানি বিকাবে; তাই সেই চাপও তার নেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যখন সব কাজ ছেড়ে প্রত্যেক বইমেলায় তিন—চারটা বই প্রকাশ করতে ‘বাধ্য’ হন, তখন প্রশ্ন জাগে—তিনি কি বই উপহার দিচ্ছেন, নাকি পণ্য? কারণ সাহিত্যিক হিসেবে তার দায়বদ্ধতার জায়গা প্রকাশকের কাছে, মানুষের কাছে নয়। চলচ্চিত্রে চাঁন কিন্তু হুমায়ূনের মতো পণ্য নয়, গান তৈরি করেছেন। তবুও কি চাঁনের গান বেঁচে থাকবে?

অথচ যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের সুবাদে ১৯০০ সালের পর থেকে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ আর থাকেনি, হয়েছে মানুষের জন্য। কিন্তু ১৭৮০’র শিল্প বিপ্লবের যে স্রোত তাতে কি ওই শিল্প (Art), এই শিল্পের (Industry) ধোপে টিকতে পারে? অথচ শিল্পীর আলাদা একটা সত্তা আছে, যেসব সময় অনৈতিক, অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে; কিন্তু সেই সত্তা শিল্পভেদে জীবিত থাকবে, না মৃত তাও আবার কিন্তু নির্ধারিত। কারণ, ‘এই ধনতান্ত্রিক সমাজে, শিল্প, চারুকলা, সঙ্গীত, মমতা, ভালোবাসা সবই পুঁজির কাছে নতজানু।’ যে কারণে চলচ্চিত্রে চাঁনের শিল্পী সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দোতারা বিক্রি করতে হয়, মেয়ের পোলাও খাওয়ার স্বপ্ন পূরণে। তাই প্রশ্নটা মনে উঁকিঝুঁকি দেয়, শিল্প তাহলে কার কথা বলে বা বলবে কিংবা বলা উচিত?

মঙ্গার ডিসকোর্স

পথ চলতে চলতে আমরা এখন যে পথে আছি, সেখানে গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শরীর থেকে সম্মান, কোনো কিছুই আর নিজের থাকে না, আর না রাখাটাই সব থেকে ‘বুদ্ধিমানের’ কাজ। তাই কারো পেট নিয়ে রাজনীতি হবে, এটা বোধ হয় ভাবার মতো অতো বড়ো কিছু নয়। যে কারণে নির্মাতা দারিদ্রকে পুঁজি করেছেন স্বাভাবিক ‘প্রবণতায়’। কিন্তু তার জন্য রংপুরকে বেছে নেওয়ার প্রয়োজন পড়লো কেনো? এ অঞ্চলে নির্মাতার নাড়ি পোঁতা বলে; নাকি নেপথ্য উদ্দেশ্য ভালো মতোই পূরণ করতে পারবে বলে।

মঙ্গা অঞ্চল হিসেবে সারাদেশে উত্তরাঞ্চলের বেশ ‘খ্যাতি’ আছে। আর আছে বলেই সেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বললে সমস্যা হয় না! তাই নির্মাতা কাকলী দ্বারস্থ হন শব্দের, দৃশ্যের, মেকআপের। প্রামাণ্য দলিল হিসেবে এটা কাজে দেবে ভালো। ৮০’র দশকে মঙ্গাকে ঘিরে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিদেশি সাহায্য আনার যে রাজনীতি সেটাই মঙ্গার ডিসকোর্সের ঐতিহাসিকতা হিসেবে কাজ করে। তারপর গণমাধ্যমসহ শিল্পে, সাহিত্যে চর্চা হতে থাকে মঙ্গার। পরবর্তী সময়ে শস্যের বহুমুখীকরণ, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ, কার্তিকে ফলবে এমন ধান উদ্ভাবন এবং ঢাকায় পাড়ি জমানো গার্মেন্ট ও নির্মাণকর্মীদের কল্যাণে উত্তরাঞ্চলের চেহারা পাল্টে গেলেও মঙ্গা ডিসকোর্স এখনো বিদ্যমান।

উত্তরের সুর-এ বিদেশিদের উপস্থাপন এই ডিসকোর্সকে আরো স্পষ্ট করে, প্রতিষ্ঠিত করে। তাই চাঁন যখন দোতারা হাতে পরিবারের ভরণ-পোষণে অপারগ হয়ে মাটি কাটার সিদ্ধান্ত নেন, ঠিক সেই মুহূর্তে তার সুযোগ হয় বিদেশিদের গান শোনানোর। বিদেশির কথা শুনে গ্রামসুদ্ধ লোক আসে শ্রোতা হয়ে। চাঁনের সুনাম বাড়েও বটে, কিন্তু তারা চলে গেলে শ্রোতা আর বাড়ে না। তাহলে কি চাঁনের গানের শ্রোতা নির্ভর করে বিদেশিদের মূল্যায়নের ওপর? চাঁন এক মাস গান গেয়ে যে টাকা পান, একদিনে সেই টাকা পান বিদেশিদের কাছ থেকে। এই সহায়তা অল্প কদিনের জন্য প্রশান্তি দেয় বটে, কিন্তু তারপর? এভাবেই মঙ্গার নামে টাকা আসে, সেই টাকায় চলে ডিসকোর্সওয়ালাদের ‘তারপর’-এর হিসাব। আর এই হিসাব টিকিয়ে রাখতে দরকার পড়ে উত্তরের সুর

অভিনয়, মেকআপ, সংলাপ ভয়ঙ্কর দুর্বল

নদীর কিনারে গায়ে জড়ানো ভেজা শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন আম্বিয়া, ক্যামেরা ধীরে ধীরে পিছন থেকে সামনে যায়। মনে হয় যেনো কোনো মডেল, ঠোঁটের কোণে হাসি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাসের শিহরণ উপভোগ করছেন; শাড়ির আঁচলটা জোর করে ছিঁড়ে, মুখে কালো ক্রিম, কাজল, লিপস্টিক মেখে দাঁড়িয়ে গেছেন পরিচালকের কথায়। একবারের জন্য মনে হয়নি—বাড়িতে পরা একটিমাত্র শাড়ির জন্য তার কোনো দুঃখবোধ আছে। পরের শটেই আম্বিয়া প্রতিবেশী বুলবুলির মায়ের সঙ্গে যখন কথা বলেন, ততোক্ষণে তার মুখের কালো মেকআপ কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। আবার অন্য একটি শটে প্রতিবেশীর বাড়িতে চাল ধার করতে গিয়ে উদ্ভট কালো মেকআপে দেখা যায়। অন্যদিকে মেয়ের মৃত্যু দৃশ্যে আম্বিয়াকে আগের তুলনায় বেশ ফরসা মনে হয়, অথচ এর কিছু সময় আগেই তিনি চাতালে গনগনে আগুনের কাছ থেকে এসেছেন।

এই মেকআপ দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, গ্রামীণ দরিদ্র নারী বোঝাতে এই রঙের ব্যবহার। অথচ গ্রামীণ খেটে খাওয়া নারীর রোদে পোড়া শরীর কিন্তু কালো নয়, তামাটে বর্ণ হয়। আর দরিদ্র আম্বিয়াকে কেনোই বা কেবল কালোই হতে হয়? কালোর সঙ্গে দারিদ্রের কী সম্পর্ক? ইথিওপিয়া যখন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র ছিলো, তখন কালোই ছিলো সৌন্দর্যের মানদণ্ড, অথচ ক্ষমতা যখন ইউরোপিয়ানদের হাতে তখন ফরসাই হয়ে উঠলো চর্চিত সুন্দর। তাই হয়তো উত্তরাঞ্চলের গরিব আম্বিয়ার শরীরের রঙ সবসময় কালোই হয়।

আম্বিয়ার মতো চাঁনের দোতারাও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রঙ বদলাতে থাকে। চাঁনের যেখানে ভাত জোটাতে কষ্টের শেষ নেই, সেখানে বাড়ি থেকে বের হন কাঁঠালি রঙের দোতারা নিয়ে। পথে যেতে যেতে তা হয়ে যায় খয়েরি রঙের!

নির্মাতা একটা গল্প বলেন ঠিকই, কিন্তু সেই গল্পের সামগ্রিকতা কেনো জানি জীবন্ত হয়ে দর্শকদের কাছে ধরা দেয় না। অভিনয় দেখে যদি বোঝাই যায়, তিনি অভিনয় করছেন—আর যাই হোক তা ঘোর সৃষ্টি করে না। যে কারণে চাঁনের নিজেকে ধরে রাখার লড়াই, সেই লড়াইয়ের কারণে সব হারানোর বেদনা দর্শকের বেদনার রসকে ঠিক ছুঁতে পারেনি অনেক জায়গাতেই। একটি চলচ্চিত্র তার সব চরিত্রের সম্মিলিত প্রয়াস, একটি দলগত কাজের মতো। উত্তরের সুর-এ তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে সন্তানের মুমূর্ষু অবস্থায় অসহায় ক্রন্দনরত আম্বিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রতিবেশী ভাবি আসলে তার মুখাবয়বে কষ্টের বদলে ‘শোভা’ পায় চাপা হাসি।

এছাড়া চাঁনের গানের একমাত্র সঙ্গী মেয়ে আয়শা একই থাকলেও তার কণ্ঠে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ব্যাপারটি সবচেয়ে খারাপভাবে ধরা পড়ে বিদেশিদের আসরে গান গাওয়ার সময়। তার পরও উত্তরের সুর ২০১২ সালে সেরা চলচ্চিত্র, কাহিনি, শিশু চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্র শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায়!

শেষকথা

প্রথম যখন মানুষকে পর্দায় চলন্ত ট্রেন দেখানো হলো, মানুষ দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো; এই ভেবে যে, ট্রেন বুঝি গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে। একশো বছর পরে এসে অবশ্য ট্রেন আর গায়ের ওপর দিয়ে নয়, মনের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর গোপনে চলে যায়। তাই তখন ভয়ে পালিয়ে বাঁচলেও, এখন বসার ঘর-শোবার ঘর জুড়ে টেলিভিশন-কম্পিউটার-মুঠোফোন যেভাবে জেঁকে বসেছে, তাতে আর যাই হোক পালানোর সুযোগ নেই। দর্শক না চাইলেও সে এই জালে আটকা পড়েছে। কারণ এখন পুঁজি নির্ধারণ করে দিচ্ছে সবার অবস্থান; তাই বলে কি এখন শিল্প সৃষ্টি হয় না? কেউ প্রথা ভাঙে না? প্রত্যেক যুগেই কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ প্রথা ভাঙার গান গেয়েছেন। আর এই বিরুদ্ধ মত আছে বলেই তো দ্বন্দ্বটা থাকে। উত্তরের সুর-এ শিল্পী হিসেবে নির্মাতা তার দায়বদ্ধতা ধরে রাখতে পারেননি। তাই চাঁন হয়েছেন বেগতিক, বেতাল।

হতাশাবাদীদের দলে ভিড়তে চাই না আমরা; স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে চাই; বাঁচাতে চাই শিল্পী-চাঁনের স্বপ্নকে।


লেখক : হালিমা খুশি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীতও করেন

khushimcj@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. এই ‘হুদ্‌ম্যা দেও’-এর গীতটি রংপুর অঞ্চলে গাওয়া হতো; এখন যদিও তার প্রচলন চোখে পড়ে না।

২. ওয়াহাব, ড. আবদুল (২০০৭ : ২৮১); ‘লোকগীতি : সংজ্ঞার্থ, স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য’; বাংলাদেশের লোকগীতি : একটি সমাজতাত্ত্বিক অধ্যয়ন; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৩. রহমান, সুমন (২০১১ : ৬৭-৬৯); ‘আর্টের নিম্নবর্গীয়পনা : গরিবের বিনোদন’; কানার হাটবাজার; বাঙলায়ন, ঢাকা।

৪.  প্রাগুক্ত; ওয়াহাব, ড. আবদুল (২০০৭ : ৪৩৮)।

৫. রহমান, সুমন; ‘বাউলগানের বাহিরানা’; প্রথম আলোর বাংলা নববর্ষের বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘বৈশাখ সংখ্যা’, ১৪ এপ্রিল ২০১৪।

৬. প্রাগুক্ত; ওয়াহাব, ড. আবদুল (২০০৭ : ৪৩৯)।

৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উদ্ধৃত; ভট্টাচার্য, চণ্ডীদাস; ‘সংস্কৃতি, বিনোদন ও আমরা’; অনুশীলন; সম্পাদনা : সাইফুজ্জামান সাকন ও স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু; অক্টোবর ২০১৪, পৃ. ১৩, ঢাকা।

৮. বশীর, মুর্তজা; ‘সৎ মানুষ খুব বিরল’; আলোকিত বাংলাদেশ-এর শুক্রবারের বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘শুক্রবার’, ১৫ আগস্ট ২০১৪।

৯. প্রেমচন্দ, উদ্ধৃত; ভট্টাচার্য, চণ্ডীদাস; ‘সংস্কৃতি, বিনোদন ও আমরা’; অনুশীলন; সম্পাদনা : সাইফুজ্জামান সাকন ও স্নেহাদ্রি চক্রবর্ত্তী রিন্টু; অক্টোবর ২০১৪, পৃ. ২০, ঢাকা।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন